নিচে এই বই টির ডাউনলোড করার দুইটি লিঙ্ক আছে এবং প্রিভিউ লিঙ্ক ও আছে
কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন নিচে আমার ফেসবুক আইডি এর লিঙ্ক দেওয়া আছে.. যদি কোনো ভুল হয় ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন
বই রিভিউ - জাদুল আসাদির তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। শিরস্ত্রাণ খোলেননি। তাঁবুর বাইরে সশস্ত্র দেহরক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার একটু অন্যদিকে গেলেন। একজন গার্ড পর্দা
ঈষৎ ফাঁক করে উঁকি দিল তাবুর ভেতর। দু’চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সুলতান। গার্ড বাইরে দাঁড়ানোর চারজন সঙ্গীর দিকে তাকার। চোখ বন্ধ করে খুলল একবার। সে চারজন দেহরক্ষী অন্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল।
তাঁবুতে ঢুকল প্রথম রক্ষী। খঞ্জর হাতে নিল। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের দিকে। খঞ্জর বাগিয়ে ধরে হাত উপরে তুলল। আইয়ুবীর বুক লক্ষ্য করে যখন নেমে আসছীল হাত, ঠিক সে মুহূর্তে পাশ ফিরলেন তিনি। রক্ষীর আঘতা গিয়ে পড়ল সালাহউদ্দীন আইয়ুরীর শিরস্ত্রাণে।
বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। নিমিষেই ঘনটা আঁচ করে নিলেন। নিজের বাছাই করা দেহরক্ষী আক্রমণ করছে দেখেও হতবাক হলেন না।
রক্ষী শিরস্ত্রাণের পাশ কেটে মাটিতে গেঁছে যাওয়া খঞ্জর টেনে তুলছিল। পলকে পূর্ণ শক্তিতে রক্ষীর মুখে ঘুসি মারলেন সালাহউদ্দীন। মট করে হাড় ভাংগার শব্দ হল। বিকট শব্দ করে চিৎ হয়ে পরে গেল রক্ষী।
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রক্ষীর হাত থেকে ছিটকে পড়া খঞ্জর নিজের হাতে তুলে নিলেন। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে ছুটে এল দু’জন রক্ষী।
‘ওকে বেঁছে ফেল।’ নির্দেশ দিলেন সুলতান।
কিন্তু ওরা সুলতানের আদেশ অমান্য করে উল্টো আইয়ুবীকেই আক্রমণ করে বসল। একা খঞ্জর দিয়ে দুই রক্ষীর তলোয়ারের মোকাবেলা করতে লাগলেন আইয়ুবী। তাবুর ভেতর শুরু হলো আসম এক লোমহর্ষক লড়াই।
দু’এক মিনিটের মধ্যেই অন্য গার্ডরাও ভেতরে প্রবেশ করল। অবাক বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত তারা তাকিয়ে রইল আউয়ুবী ও রক্ষীদের অসম লড়াইয়ের দিকে। সম্বিত ফিরে এলে একজন এগিয়ে এসে আঘাত করল রক্ষীদের। দেখাদেখি অন্য রক্ষীরাও ঝাঁপিয়ে পড়র। এবার রক্ষীরা দুই দল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করল। আপন পর পার্থক্য করতে না পেরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।
সংঘর্ষ থেমে গেল। দু’জন নিহত হল এই সংঘর্ষে। আহত হল কয়েকজন, পালিয়ে গেল একজন। তদন্ত শেষে দেখা গেল দেহরক্ষীদের সাতজন ছিল ঘাতক দলের সদস্য। গুমাস্তিগীন নামে খলিফা সালেহের এক কেল্লাধিপতি আইয়ুবীকে হত্যার জন্য এদের নিয়োগ করেছিল।
সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা পরপর ব্যর্থ হল। এ হত্যা পরিকল্পনার হোতা ছিল সাইফুদ্দীন। সাইফুদ্দীন ছিল সালাহউদ্দীনের চাচাতো ভাই খলিফা আস সালেহের একজন আমীর। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান হলেও কার্যত ইসলামী দুনিয়া ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণরগণ সুলতান উপাধি ধারণ করে বলতে গেলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এ ঘনটার পর একদিন ভোরে সাইফুনদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি চিঠি পাঠালেন সালাহউদ্দীন আইয়ুরী। তাতে তিনি লিখলেন, “খাঁচায় বন্দী পাখীল মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা।’
চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি ১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসে। খলিফা সালেহ এবং সাইফুদ্দীন খৃস্টানদের সহযোগিতায় আইয়ুরীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। পরাজিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। তার তাঁবুতে পাওয়া গেল আগণিত সম্পদ। পাওয়া গেল খাঁচায় বন্ধী রঙবেরঙের পাখী, এক ঝাঁক সুন্দরী তরুণী, নর্তকী, গয়িকা। বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র আর পিপা ভর্তি মদ।
সালাহউদ্দীন খাঁচায় দুয়ার খুলে দিলেন, পাখীরা উড়ে গেল উন্মুক্ত আকাশে। নর্তকী, গায়িকা আর তরুণীদের মুক্ত করে দিলেন। চিঠি লিখলেন আমীর সাইফুদ্দীনের কাছে, ‘তোমরা বেঈমানী করে খৃস্টানদের সহযোগিতায় আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছ। একবারও কি ভেবেছ, তোমাদের এ ষড়যন্ত্র ইসলামী বিশ্বের মানচিত্র মুছে দিতে পারে? যদি আমাকেই ঈর্ষা কর, যদি আমিই তোমাদের শত্রু হয়ে থাকি, মেরে ফেল আমায়। দু’বার সে চেষ্টাও করেছ। সফল হওনি, আবার না হয় চেষ্টা করে দেখ। এবার সফল হলে হতেও পার।
যদি নিশ্চয়তা দিতে পারো, আমাকে হত্যা করলে ইসলাম আরো গৌরবোজ্জ্বল হবে, তবে আমার মাথা কেটে তোমাদের পায়ের কাছে রেখে দিতে বলব। মনে রোখো, অমুসলিম কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারেনা। ইতিহাস এর সাক্ষী। ফ্রান্স সম্রাট এবং রিমাণ্ডের মত খৃস্টানকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সহযোগিতা করছ বলে তোমরা ওদের বন্ধু। ওরা সফল হলে ওদের প্রথম শিকার হবে তোমরাই। এরপর পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নামও মুছে যাবে।
তোমরা যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য হওয়া তোমাদের জাতীয় পেশা। প্রতিটি মুসলমানই আল্লাহর সৈনিক। তার জন্য শর্ত কেবল ঈমান ও সৎ কাজ। খাঁচায় বন্দী পাখীর মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা। অনুরোধ করি, আমার সাথে সহযোগিতা কর। জিহাদে শরীক হও, না হলে কমপক্ষে বিরোধিতা করো না। আমি তোমাদের কোন শাস্তি দেবনা। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’
-সালাহউদ্দীন আইয়ুরী।
এ সব যুদ্ধের ফলে অজস্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে এসেছিল। বন্দীর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলেন। এক ভাগ দিলেন সৈন্য এবং গরীবদের। তৃতীয় ভাগ পাঠিয়ে দিলেন নিজমুল মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নিজের জন্য এবং জেনারেলদের জন্য কিছুই রাখেননি। বন্দীদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। কিছু অমুসলিমও ছিল, আইয়ুবীর মহানুভবতায় ওরা তার আনুগত্য গ্রহণ করে সোবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেল।
ইবনে সাবার ফেদাই গ্রুপ দু’বার সালাহউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল। ফেদাইদেরকে ঐতিহাসিকগণ ঘাতক দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দু’দু’বারই তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয় আক্রমণ হল খৃস্টান এবং সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করার পর। সাইফুদ্দীন পালিয়ে গুপ্তঘাতক দলের সাহায্য কামনা করল।
সালাহউদ্দীনের প্রায় একশো বছর আগে হাসান ইবনে সাবা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন উপদলের জন্ম দিয়েছিল। নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। কিছু অলৌকিক কাজ দেখিয়ে মানুষকে অনুসারী বানাতো। সুন্দরী তরুণী, মদ, হিপটোনিজম এবং চাটুকারিতা ছিল ওদের পুঁজি। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘাতক দল। ওরা মানুষকে হত্যা করত গোপনে।
এরা ছিল সতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুঃসাহসী। এরা পোশাক আশাক এবং ভাষা পরিবর্তন করে বড় বড় জেনারেলের দেহরক্ষীর চাকরী নিত। সময় সুযোগ বুঝে এমন ভাবে সারত হত্যার কাজ, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যেতনা। ধীরে ধীরে ইবনে সাবার দল ঘাতকদল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল। রাজনৈতিক হত্যাকানণ্ডে ওরা ছিল পারদর্শী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার কাজে ব্যবহার করত বিষ। সুন্দরী যুবতীরা মদের সাথে এ বিষ মিশিয়ে দিত।
সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে রূপসী নারী দিয়ে বা মদ খাওয়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। তিনি এ দুটো থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন সতর্কভাবে। ফলে আকস্মিক আক্রমণ ছাড়া তাকে হত্যা করার অন্য কোন পথ ছিল না। কিন্তু বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ দেহরক্ষীদের উপস্থিতিতে তাও ছিল অসম্ভব। সালাহউদ্দীন ভেবেছিলেন পরাজয়ের পর সালেহ এবং সাইফুদ্দীন আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না। সম্মিলিত বাহিনীল অহমিকা চুর্ণ হবার পর আইয়ুবীর সাথে টক্কর দেওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ওরা।
বিজয়ের পর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখলেন। দখল করলেন গাজাসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী- দুঃসাহসী এক যোদ্ধা, অসাধারণ এক সেনাপতি। ইসলামের শত্রুরা আজো তাকে সম্বোধন করে ‘গ্রেট সালাদীন’ বলে, মুসলমনরা স্মরণ করে জাতীয় বীর হিসাবে।
মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা রয়েছে তার নাম। খৃস্টান জগৎ তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর রণকৌশলৈর কথা কোনদিন ভুলতে পারবেনা। ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তার জয় পরাজয়ের বিস্ময়কর কাহিনী। কিন্তু ক্রুশের ধ্বজাধারীরা মদ আর রূপের মায়াজালে যে ষড়যন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিল, নিজেদের সে সব অপকর্মের চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি।
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। মিসরের গভর্ণর এবং সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। তিনি ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। অল্প বয়সেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন শাসক রাজা নয়, শাসক হলো ইসলামের রক্ষক। বুদ্ধি হওয়ার পর তিনি দেখেছিলেন মুসলিম শাসকদের অনৈক্য। বিলাসপ্রিয় শাসকবর্গ সুন্দরী রমণী আর মদে আকণ্ঠ ডুবেছিল। গাদ্দারী, বিলাসিতা আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যত।
রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হারেমের শোভা বর্ধন করছিল ইহুদী আর খৃস্টান যুবতীরা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব সুন্দরী রমনীদের রূপের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছিল মানুষের ইসলামী জোশ আর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার আবেগ অনুভূতি।
এ সুযোগে খৃস্টান শাসকগণ একের পর এক ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিল। মুসলিম শাসকবর্গ প্রজার রক্ত শুষে খৃষ্টানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করত। ওদের সেনা শক্তির ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্ত হয়ে থাকত। খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে ভোগবিলাসের হারেমে বন্দী রেখে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল।
সালাহউদ্দীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিজাম-উল-মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে খালেছ ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। আর সে জন্যই ঘাতকদলের প্রথম শিকার ছিলেন নিজাম-উল-মুলক। রোমানদের রাজ্যবিস্তারে তিনি ছিলেন বড় বাঁধা। এ বাঁধা দূর করার জন্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সালাহউদ্দীন এখানেই সেনা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন নুরুদ্দীন জংগী। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী এখানেই অর্জন করেছিলেন তিনি। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী গোয়েন্দা বৃত্তি, কমাণ্ডো অভিযান এবং গেরিলা অপারেশনকে সবচে’ বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দেখেছিলেন গুপ্তচর বৃত্তিতে খৃস্টান জগৎ অনেক অগ্রসর। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা আর সাংস্কৃতিক অংগন ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সালাহউদ্দীন অত্যান্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা করেছিলেন।
তিনি মিসরের গভর্ণর ও সেনাবাহিনী প্রধন হয়ে এলে শুরু হল ষড়যন্ত্র। বড় বড় জেনারেলরা এ পদের জন্য ছিল লালায়িত। তারা যখন দেখল তাদের আশায় গুড়ে বালি, তখনা ক্ষুব্ধ জেনারেলগণ ষড়যন্ত্র শুরু করল তার বিরুদ্ধে।
ওদের ধারনায় সালাহউদ্দীন একজন বাকলমাত্র। এ পদের যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জেনারেলদের সে ধারণা ভেঙে গেল। সালাহউদ্দীন কঠোর নিয়ম শৃংখলা মেনে চলতেন। সৈন্যদের জন্য ভোগবিলাস এবং মদ নিষিদ্ধ করলেন। মনোনিবেশ করলেন ওদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। ফলে অল্প দিনেই সেনাবাহিনী সুশৃংখল ও সুসংগঠিত হয়ে উঠল। অল্পবয়স্ক অর্বাচীন বালক বলে তাকে যারা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল, টনক নড়ে উঠল তাদের।
সালাহউদ্দীন খৃষ্টান শক্তির মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী সেনা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুক্ত ফিলিস্তিনে শ্বাসন নেয়ার দুর্মর আকাঙ্খা নিয়ে সেনাবাহিনীকে সে ভাবে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যে খোদা আমাকে মিসরের গভর্নর করেছেন, অবশ্যই তিনি ফিলিস্তিনও মুক্ত করবেন।’ তার এ ঘোষণার জন্য কেবল খৃস্টানই নয়, খৃস্টানপন্থী মুসলমান আমীর ওমরারাও তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। বাইরের শত্রুর চাইতে ঘরের শত্রুরা হয়ে উঠল তার জন্য অধিকতর বিপজ্জনক।
নতুন গভর্নরের অভ্যর্থনার আয়োজন করা হল। আয়োজন করলেন জেনারেল নাজি। পঞ্চাশ হাজর ফৌজের অধিনায়ক তিনি। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ছাড়াও বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত। মুচকি হেসে একে একে সকলের সাথে করমর্দন করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কণ্ঠে স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণ পরশ। কোন কোন অফিসারের ঠোঁটে কুটিল হাসি। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর উপহাস। ওদের ধারনা, নুরুদ্দীন জংগীর সাথে সুসম্পর্ক এবং রাজপরিবারেির সন্তান বলেই সারাহউদ্দীন গভর্নর হতে পেরেছেন। এক প্রবীণ অফিসার আরেকজনের কানে কানে বলল, ‘এখনো শিশু, আমরা পেলে পুষে নেব।’
অনুষ্ঠানে তাকে শিশুই মনে হচ্ছিল। জেনারেল নাজির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। কপাল কুঞ্চিত হল ঈষৎ। করমর্দনের জন্য হাত প্রসারিত করলেন। নাজি তোষামুদে দরবারীদের মত সালাহউদ্দীনকে কুর্নিশ করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আপনার জীবন রক্ষার্থে আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও বিলিয়ে দেব। আপনি আমাদের কাছে মাননীয় জংগীর আমানত।’
‘ইসলামের চাইতে আমার জীবনের দাম বেশী নয় সম্মানিত জেনারেল।’ আইয়ুবী বললেন, ‘প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা মুসলিম বিশ্বের আকাশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’
জবাবে মৃদু হাসলেন নাজি। যেন তাকে রূপ কথার গল্প শোননো হচ্ছে। নাজি ছিল ফাতমী খেলাফতের সিপাহসালার। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক। সৈন্যদের সবাই ছিল সুদানের অধিবাসী। তার বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলতে গেলে এরা ছিল নাজির ব্যক্তিগত সৈন্য। নাজি ছিল মুকিটহীন সম্রাট।
তখন মুসলিম দেশগুলোর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল খৃস্টান জগৎ। মিসর এবং আশপাশের শাসকদের জন্য নাজি ছিল এক ত্রাস। তার মস্তিষ্ক ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ভেড়া দেখলে নেকড়ের যেমন দাঁত বেরিয়ে আসে, সালাহউদ্দীনকে দেখে নাজিরও তেমনি দাঁত বেরিয়ে এসেছিল। আইয়ুবী তার এ ক্রুর হাসির মর্ম না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এ শক্তিধর জেনারেলকে তার প্রয়োজন।
‘হুজুর অনেক দূর থেকে এসেছেন। খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ নাজি বলল।
‘যে কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে, আমি তার যোগ্য নই। এ দায়িত্বভার আমার বিশ্রাম এবং নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে অফিসে গেলেই কি ভাল হয় না?’
‘হুজুর কি আগে খেয়ে নেবেন?’ বলল একজন অফিসার।
একটু ভেবে ওদের সাথে হাঁটা দিলেন আইয়ুবী। দু’সারিতে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র গার্ডবাহিনী। ওদের হাতের অস্ত্র এবং পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ দেখে তার চেহারায় হেসে উঠল আনন্দের দ্যুতি। দরজার কাছে পৌঁছতেই চেহারায় এ আলো হঠাৎ নিভে গেল। তার বদলে হতাশার আঁধার এসে গ্রাস করল তাকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন রূপসী তরুণী। তাদের পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রেশম কোমল চুল। পরনে পাতলা পোশাক। হাতে ফুলের ঝুড়ি। সালাহউদ্দীনের পথে ওরা ফুল ছুঁড়তে লাগল। সাথে সাথে বেজে উঠল দফ ও রবাবের সুর ঝংকার।
থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। ডানে বাঁয়ে নাজি এবং তার সহকারীরা। ভারতীয় রাজরাজড়াদের মত ওরা নুয়ে তাকে সামনে চলার জন্য অনুরোধ করল।
‘সালাহউদ্দীন ফুল মাড়ানোর জন্য আসেনি।’ গমগম করে উঠল আইয়ুবীর কণ্ঠ। ঠোঁটে শ্লেষের হাসি। যে হাসি দেখতে ওরা অভ্যস্ত নয়। ‘হুজুর চাইলে আমরা আকাশের তারা এনে দিতে পারি’ নাজি বলল।
‘আমাকে খুশী করতে হলে একটা জিনিসই আমার পথে ছড়ানো যেতে পারে।’
খৃস্টানদের লাশ।’ মৃদু হেসে বললেন সালাহউদ্দীন।
ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল অফিসারের।
মুহূর্তে বদলে গেল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চেহারা। দু চোক থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল আগুনের হলকা। বললেন, মুসলমানদের জীবন ফুলশয্ডা নয়। আপনারা কি জানেন না খৃস্টানরা মুসলিম বিশ্বকে ইঁদুরের মত কেটে টুকরো টুকরো করে চলছে?’
তার গম্ভীর কণ্ঠের ধ্বনি বদলে দিল ঘরের পরিবেশ। প্রতিটি শব্দ থেকে বিস্ফোরিত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘আমাদের মেয়েদের উলংগ করে ওদের ইজ্জত পদদলিত করেছি বলেই আজ আমরা ফুল মাড়াতে পারছি। শুনুন, আমার দৃষ্টি আটকে আছে ফিসিস্তিনে। আপনারা কি আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিশর থেকে ইসলামকে বিদায় করতে চাইছেন?’
তিনি চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার পথ থেকে ফুল সরিয়ে নাও। এ ফুলে পা পড়লে আমার হৃদয় কাঁটার ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। সরিয়ে দাও মেয়েদের। আমি চাইনা ওদের সোনালী চুলে জড়িয়ে গিয়ে আমার তরবারী গতি হারিয়ে ফেলুক।
‘হুজুরের ইজ্জত সম্মান. . . . .।’
আমাকে আর কখনো হুজুর বলবে না।’ ঝাঁঝের সাথে বললেন তিনি। মনে হল শব্দের তীব্র আঘাতে ওদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। ‘তোমরা যার কালেমা পড়েছ হুজুরতো তিনি। আমি তাঁর দাসানুদাস মাত্র। সে হুজুরের জন্য আমার জীবন নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে চাই। তার পয়গাম আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। খৃস্টান জগৎ ওই পয়গাম ছিনিয়ে নিয়ে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ডুবিয়ে দিতে চাইছে মদের দরিয়ায়। আমি বাদশা হয়ে এখানে আসিনি।’ নাজির চোখের ইশারায় মেয়েরা ফুল কুড়িয়ে দরজা থেকে সরে গেল। দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকলেন সালাহউদ্দীন। প্রশস্ত কক্ষ। ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল টেবিল। টেবিলে নানা রকম সুস্বাদু খাবার। ‘
খাবারে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি তাকালেন সহকারী সালারের দিকে।
‘মিসরের সব মানুষ কি এমন খাবার খেতে পারে?’
‘না হুজুর’। সহকারীর জবাব, ‘গরীবরা তো এসব খাবার স্বপ্নেও দেখেনা।’
‘তোমরা কোন্ সমাজের লোক? যারা এমন খাবার স্বপ্নেও দেখেনা ওরা কি তোমাদের চেয়ে ভিন্ন জাতি?’
সকলেই নির্বাক।
‘এখানে যত চাকর-বাকর এবং ডিউটিরত সেপাই রয়েছে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। এ খাবার ওরা খাবে।’
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী একটা রুটির সাথে ক’টুকরা তরকারী তুলে তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করলেন। এরপর নাজিকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলেন গভর্নর হাউসের দিকে।
দু’ঘন্টা পর। গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এল নাজি। দ্রুত এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।
রাত নেমেছে। নাজি খাস কামরায় কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে। নাজি বলল, ‘যৌবনের তেজ কয়েক দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা করে দেব। কমবখ্ত বলল কি জান? বলল, কাবার প্রভুর শপথ! মুসলিম বিশ্ব থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করে তবে আমি বিশ্রাম নেব।’
‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী? হুহ্!’ সহকারী সালারের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। ‘ইসলামী রাষ্ট্রের দম ফুরিয়ে গেছে সে এ খবরও জানেনা। এখনতো সুদানীরা দেশ চালাবে।’
অন্য এক কমাণ্ডার প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাশ হাজার ফৌজের সবাই সুদানী একথা তাকে বলেননি। বলেননি যে ওরা আপনার নির্দেশে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?’
‘তোমার কি মাথা খারাপ এডরোস? আমি বরং তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। বলেছি আপনারা ইশারা পেলৈ আমসরা সৈন্যরা খৃষ্টানদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কিন্তু. . .’
থেমে গেল নাজি।
‘কিন্তু কি?’
‘মিসরের লোকদেরকে ফৌজে ভর্তি করার জন্য সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। কারণ ফৌজ এক এলাকার থাকা নাকি উচিৎ নয়। সে মিসরের লোকদেরকে আমার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।’
‘আপনি কি বললেন?’
‘বলেছি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে। কিন্তু আমি তা করব না।’
‘তার মনমানসিকতা কেমন বুঝলেন?’
‘একরোখা জেদী।’
‘আপনার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সামনে সে এখনো শিশু। নতুন গভর্ন হয়ে এলো তো! কদিন পরই পদের নেশায় পেয়ে বসবে।’
‘আমি তার এ নেশা দূর করবো না। নেশায় নেশায় তাকে নিঃশেষ করব।’
ওরা অনেকক্ষণ ধরে আইয়ুবীকে নিয়ে কথা বলল। নতুন গভর্নর এই মুকুটহীন সম্রাটের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে কি পদক্ষেপ নেয় হবে তাও আলোচিত হল।
অন্যদিকে আইয়ুবী তার সহকারীদের বলছিলেন, ‘আমি এখানে রাজা হয়ে আসিনি। কাউকে রাজত্ব করতেও দেবো না।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের সামরিক শক্তির প্রয়োজন। এখানকার সেনাবাহিনীর গঠন পদ্ধতি আমার পছন্দ নয়। পঞ্চাশ হাজর ফৌজের সবাই সুদানী। অথচ সব এলাকার লোকেরই সৈন্য হবার অধিকার আছে। এভাবে ওদের জীবনের মানও উন্নত হতে পারে। সব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি করার জন্য আমি নাজিকে বলে দিয়েছি।
‘নাজি কি আপনার নির্দেশ পালন করবে?’ একজন সহকারী প্রশ্ন করল।
‘কেন, সে কি আমার হুকুম অমান্য করবে নাকি?’
‘করতেও পারে। ফৌজের সর্বময় কর্তা তিনি। তিনি কারো নির্দেশ পালন করেন না, বরং অন্যকে তার নির্দেশ পালনে বাধ্য করেন।’
এ কথায় সালাহউদ্দীন একটু নীরব রইলেন। তবে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কি ভাবছেন তা বুঝে উঠার আগেই আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে অন্যদের বিদায় জানালেন তিনি।
আলী মধ্য বয়সী এক চৌকস গোয়েন্দা লিডার। কুশলী, সাহসী এবং অসম্ভব বাকপটু। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য সে বিশ্বস্তক ও নিবেদিতপ্রাণ কিছু লোককে ট্রেনিং দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব গোয়েন্দা দল। আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতে বললেও যারা পিছপা হবে না। চিন্তা চেতনার দিক থেকে সে ছিল আইয়ুবীর সমমনা। সালাউদ্দীন তাকে বাগদাদ থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।
‘শুনলাম তো। চিনতে ভুল না করলে বলব, লোকটি ধুরন্ধর ও বড় ধরনের ক্রিমিনাল। তার ব্যাপারে আগে থেকেও আমি কিছুটা জানি। জনগণের টাকায় লালিত সেনাবাহিনী এখন তার নিজস্ব ফৌজ। তার ষড়যন্ত্রের ফলে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘সব এলাকার লোকই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার প্রয়োজন’ আপনার এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং সঠিক হয়েছে। আমার তো আশংকা হচ্ছে সুদানী সৈন্যরা প্রয়োজনের সময় আপনার হুকুম অমান্য করে তারই অনুগত্য করবে। বলা যায়না, ফৌজের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে নাজিকে আনপার অপসারণও করতে হতে পারে।
‘না, নাজির মত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে এখনই বিরূপ করতে চাই না। এ মুহূর্তে তাকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরানোর জন্য আমি অস্ত্র হাতে নেইনি, আমাদের তরবারী শত্রুর জন্য। আমি আগে ভালবাসা দিয়ে তাকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করব। তুমি বর্তমান সেনাবাহিনী আমাদের কদ্দুর কাজে আসবে তা-ই বোঝার চেষ্টা কর।’
‘আপনার ভালবাসা তাকে শুধরাতে পারবে বলৈ মনে হয় না’।
সালাহউদ্দীন যা ভেবেছিলেন নাজি ততোটা সহজ ছিল না। ভালবাসা শব্দটি তার অভিধানে ছিল না। তার সব প্রীতি এবং মমতা ছিল ক্ষমতার সাথে। ক্ষমতার প্রশ্নে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর। মানুষ হিসাবে ছিল অসম্ভব ধূর্ত। ষড়যন্ত্র ছিল তার হাতিয়ার। কাউকে ফাঁসাতে চাইলে তার সাথে মোমের মত কোমল ব্যবহার করত। আইয়ুবীর সাথ তার ব্যবহার ছিল অনুগত দাসানুদাসের মত। তার সামনে সে কখনো বসত না। আইয়ুবীর প্রতিটি কথায় জি-হুজুরীর ভূমিকা পালন করত।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে মিসরের সকল অঞ্চল থেকেই সেনা ভর্তি শুরু করে দিয়েছিল। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুবীও তাকে একটু একটু পসন্দ করা শুরু করেছেন। নাজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সেনাবাহিনী আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়। ফৌজের পক্ষ থেকে নতুন গভর্নরকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার প্রস্তাবও দিল সে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তিনি তার এ আমন্ত্রণ মুলতবী রাখলেন।
রাত নেমেছে। নিজের কক্ষে দু’জন কমাণ্ডার নিয়ে মদ পান করছিল নাজি। মৃদু লয়ে বাজছে সংগীতের সুর মুর্ছনা। তালে তালে নাচছে দু’জন নর্তকী। পায়ে নুপুর নেই। বে আব্রু দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাদকতা। প্রহরী ভেতরে এসে নাজির কানে কানে কি যেন বলল।
মদির আবেশে মত্ত নাজির আনন্দে বিঘ্ন ঘটাবার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু এ আসর থেকে তাকে কোন্ সময় তুলে নেয়া যায়’ প্রহরী তা জানত।
উঠে দাঁড়ালেন নাজি। প্রহরী তাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। সুদানী পোশাক পরে একজন লোক বসে আছে। সাথে এক যুবতী।
নাজিকে দেখে দু’জন উঠে দাঁড়াল। যুবতীর রূপ মাধুর্য দেখে নাজি খানিক হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। সে নারী শিকারী। শুধু ভোগের জন্যই নয়, বড় বড় অফিসারদের ব্লাকমেল অথবা তাদেরকে হাতে রাখরা জন্যও সুন্দরী যুবতীদের ব্যবহার করত নাজি। কসাই যেমন পশু দেখলে গোশত পরিমাণ করতে পারে, সেও প্রথম দেখাতেই বুঝত কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে। নারী ব্যবসায়ীরা প্রায়শই তার কাছে মেয়ে নিয়ে আসত।
বিক্রেতা যুবতীর ব্যাপারে বলল, ‘দারুণ স্মার্ট। নাচতে পারে, গাইতে পারে, মুখের মধুতে পাথরও গলিয়ে দিতে পারে।’
নাজি ওর ইন্টারভিউ নিয়ে চমৎকৃত হল। ভাবল, একটু তৈরী করে নিলে যে কোন কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
দাম দস্তুর শেষে টাকা নিয়ে চলে গেল লোকটি। নাজি ওকে নিয়ে চলে এল জলসা ঘরে। নাচতে বলল তরুলীকে। দেহের বাড়তি কাপড় ফেলে দিয়ে দু’পাক ঘুরতেই হা হয়ে গেল তিন দর্শক। ফ্যাকাশে হয়ে গেল আগের দু’নর্তকীর চেহারা। নতুন মেয়েটার সামনে ওরা এখন মূল্যহীন বাসি ফুল।
আসর ভেঙে দিল নাজি। নতুন মেয়েটাকে রেখে সকলকে বিদায় করে দিল।
‘নাম কি সুন্দরী?’
‘আমার নাম জুলি’।
‘তোমাকে যে দিয়ৈ গেল সে বলেছে, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার সে যোদ্যতা যাচাই করতে চাই। ‘
‘কে সে পাথর?’
‘মিসরের নতুন গভর্নর। যিনি একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও।’
‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী?’
‘হ্যাঁ, যদি তাকে বশে আনতে পার তবে তার ওজন সমান সোনা তোমার পুরস্কার।’
‘তিনি কি মদ পান করেন?’
‘না, মুসলমান শূকরকে যেমন ঘৃণা করে, সে দম, নারী, নাচ, গান এবং ভোগবিলামকে তেমনি ঘৃণা করে।’
‘শুনেছি আপনার কাছে এমন সব যুবতী রয়েছে যাদের দেহের যাদু নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওরা কি ব্যর্থ?’
‘এখনো পরীক্ষা করে দেখিনি। আমার বিশ্বাস তুমি এ কাজ করতে পারবে। সালাহউদ্দীনের বিশ্বাস এবং চরিত্র সম্পর্কে আমি তোমাকে বিস্তারিত বলবো।’
‘তাকেকি বিষ খাওয়াতে হবে?’
‘এখন নয়। তার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি চাই সে তোমার মত রূপসীর আঁচলে বাঁধা পড়ুক। এরপর তাকে আমার পাশে বসিয়ে মদ খাওয়াব। মারতে চাইলে তোমার প্রয়োজন নেই, ঘাতক দলকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়।’
‘তার মানে আপনি দুশমনি নয় বন্ধুত্ব চাইছেন?’
জুকির বুদ্ধিমত্তায় নাজি কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
‘হ্যাঁ জুকি।’
ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল নাজি, ‘আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। এমন বন্ধুত্ব, যেন সে আমার কথায় উঠে এবং বসে। এর পর কি করতে হবে তা আমি জানি।’ থামল নাজি।
একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। সালাহউদ্দীনের হাতেও একটা চাল আছে। তোমার রূপ যৌবনের ওপর তার চাল বিজয়ী হলে তুমি বাঁচতে পারবে না। সালাহউদ্দীনও তোমায় বাঁচাতে পারবে না। তোমার জীবন আমার হাতে। এ জন্যই তোমার সাথে এত খোলামেলা কথা বলছি। নইলে আমার মত জেনারেল তোমার মত এক গনিকার সনাথে এভাবে আলাপ করত না।’
‘অনাগত ভবিষ্যত বলে দেবে কে ধোঁকা দেয়। এবার বলুন তার কাছে আমি পৌঁছব কিভাবে?’
‘আমি তার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। রাতে তার শয়ন কক্ষে তোমায় ঢুকিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে, এর পরের কাজ হবে আমার।
সে রাতের পর আরও ক’টা রাত চলে গেছে। প্রশাসনিক কাজ এবং নতুন সৈন্য ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আইয়ুবী নাজির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। এর মধ্যেই নাজি সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের আরো রিপোর্ট পাওয়া গেল। আলীর সে রিপোর্ট পেয়ে সালাহউদ্দীন চিন্তিত হয়ে উঠলেন।
‘আলী! এর অর্থ হল সে খৃষ্টানদের চাইতেও বিপদজনক।’
‘লোকটা মিসরের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সাপ। প্রশাসনের অনেক বড় বড় লোক তার হাতে। সেনাবাহিনীও আমাদের নয় বরং অন্যের অনুগত। এ ব্যপারে কি করা যায় কিছু ভেবেছেন?’
‘শুধু ভাবিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি। সুদানী সৈন্যদেরকে নতুন সৈন্যদের সাথে একীভূত করে দেব। এখন এরা না হবে সুদানের, না মিসরের। এপর নাজিকে সোজা পথে নিয়ে আসা যাবে।’
‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সে খৃষ্টানদের সাথে নিজের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বকে এক কেন্দ্রের আওতায় এনে আপনি মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছেন। কিন্তু নাজি আপনার ও ইচ্ছেকে পাগলামী মনে করে।’
‘তুমি কি করছ?’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার চারপাশে আমি গুপ্তচরের প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছি। মনে করুণ সে এখন গোয়োন্দাদের দুর্গে বন্দী। আমি সব বিষয়েই আপনাকে অবহিত করব।’
আলীর ওপর ছিল সালাহউদ্দীনের পূর্ণ আস্থা। তাই তার গোপন তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করলেন না।
‘শুনলাম নাজি আপনাকে সম্বর্ধনা দিতে চাইছে। যেতে চাইলে আমি যখন বলব তখন যাবেন।’
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী কতক্ষণ ঘরময় পায়চারী করলেন। হঠাৎ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এর ব্যথাভরা ‘আহ’ শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। তাকালেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে।
‘আলী, জীবন মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে জন্মের সাথে সাথেই কি মরে যাওয়া ভাল নয়? কখনো ভাবি, যাদের মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ নেই, নেই কোন মহৎ ভাবনা সম্ভবতঃ পৃথিবীতে তারাই সুখী। ওরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকে, মরেও যায় তেমনি।
‘না, সম্মানিত আমীর! ওরা সবচে বেমী হতভাগা।’
‘হ্যাঁ আলী। আমি যখন ওদেরকে ভাগ্যবান মনে করি কে যেন আমার কানের কাছে এসে তোমার কথাটাই উচ্চারণ করে যায়। মনে রেখো আলী, ইতিহাসের বর্তমান ধারা পরিবর্তন করতে না পারলে মুসলিম বিশ্ব হারিয়ে যাবে উপত্যকা আর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তারে। খেলাফত এখন তিন ভাগে বিভক্ত। আমীর ওমরার দল স্বেচ্ছাচারী, খৃস্টান ষড়যন্ত্রের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমার আশংকা হচ্ছে, মুসলমানরা বেঁচে থাকলেও থাকবে খৃষ্টানদের গোলামীর শৃংখলিত। শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকবে ওরা। জাতিসত্ত্বা বলে কিছুই থাকবে না, যেন সে শুধু এক মৃতের কফিন। দেখছো না, অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই আমাদের মানচিত্র কতো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে!’
মাথা নুইয়ে আবার তিনি পায়চারী করতে লাগলেন। কুঞ্চিত কপালে চিন্তার ভাজ। এক সময় মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে গমগম কণ্ঠে বললেন, ‘আলী, নিজের ভেতর থেকে ধ্বংস শুরু হলে তা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের খেলাফত এবং আমীরগণ বর্তমান অবস্থায় থাকলে খৃষ্টানদের আক্রমণ করার প্রয়োজনই পড়বে না। যে আগুণ আমাদের ঈমান, আমাদের কর্ম আর জাতিসত্ত্বাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে খৃস্টানরা তাতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মাত্র। ওদের ষড়যন্ত্র আমাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করছে। হয়তো আমার ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে যাবে। আমি পরাজিত হতে পারি, তবুও জাতির কাছে আমি কিছু কথা রখে যেতে চাই। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, অমুসলিমকে কখনো বিশ্বাস করো না। যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেবে, তবু দুশমনের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।’
‘মনে হচ্ছে আপনি হতাশ হয়ে গেছেন?’
‘না আলী, নিরাশ হইনি, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আলী, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে আমাদের নির্দেশ পৌঁছে দাও। সেনা ভর্তি আরো তীব্রতর কর। যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সবসময় প্রাধান্য দেবে। সৈন্য ভর্তির বাধ্যতামূলক শর্ত হল ইসলামী আমল আখলাক। শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেবে। ওদেরকে স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং দেবে। শত্রুর এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে ওদের। ওরা হবে সুইসাইড স্কোয়ার্ড। গেরিলাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর। ওদের থাকতে হবে উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুঁৎ পিপাসা সহ্য করার শক্তি। দৃষ্টি হবে ঈগলের মত, মরু শিয়ালের মত হবে সতর্ক। চিতাবাঘের মত ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। শক্তি সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় হবে অনন্য। মদ হাসিস বা এ জাতীয় মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে ওদের। ওদেরকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সব নারীদের যৌবনের পশরা সাজিয়ে, চোখে মদির নেশা জাগিয়ে যারা আসবে ওদের ছোবল হানতে। এ ব্যাপারগুলো এদের এমন ট্রেনিং দেবে, যেনো নৃত্যরত পরী এলেও ওরা থাকতে পারে বরফশীতল।
ভর্তি আরো তীব্রতর করো আলী। মনে রেখো, আমি আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতে পসন্দ করিনা। সংখ্যায় যত নগন্যই হোক, আমি যোদ্ধা চাই। সেই সব যোদ্ধা, যাদের ভেতরে থাকবে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনাবোধ। কেন যুদ্ধ করছি এ প্রশ্ন কখনো কারো মনে উদয় হবে না। শুরুতকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য কি তা ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দাও। এ দুর্দিনে জাতি তাদের কাছে কতটুকু ত্যাগ ও কোরবানী দাবী করে এ কথা প্রত্যেকটি সৈনিকের অন্তরে এমন ভাবে গেঁথে দাও, যাতে এটাকে কেউ কেবল চাকরী মনে না করে।’
নাজি তার ক্ষমতা ও প্রাধান্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি দুঃসাহসিক গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলেছিল। ওরা নাজিকে বলল, ‘আলী বিন সুফিয়ান সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর বিশেষ উপদেষ্টা এবং গুপ্তচর বৃত্তিতে আরব শ্রেষ্ঠ। আপনার অস্তিত্বের জন্য সে এক মারাত্মক হুমকী স্বরূপ।’
নাজি আলীর পেছনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিল। তাদের রিপোর্টের পর সে আলীকে হত্যা করারও পরিকল্পনা করল। সালাহউদ্দীনকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে তৈরী করেছিল নাজি, কিন্তু সে জানতেও পারেনি, নিজেই সে জুকির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু অসাধারণ রূপের জৌলুষেই নয়- জুকির মধুমাখা কণ্ঠে ছিল যাদুর ছোঁয়া। ওকে নিজের পাশে বসিয়ে কথা বলত নাজি।
এখন আর পুরনো নর্তকীদের ডাক পড়েনা। ঈর্ষার আগুণে পুড়ে মরতে লাগল ওরা। এ ঈর্ষার আগুন ওদের এতটাই ক্ষিপ্ত করলো যে, পুরনো নর্তকী দু’জন জুকীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কার্যত এ ছিল অসম্ভব। ওর কক্ষের সামনে সারাক্ষণ দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া নর্তকীরা বাইরে যেতে পারত না। অনেক ভেবেচিন্তে ওরা হারেমের এক চাকরাণীকে হাত করে নিল।
গভর্ণরের পুরনো বডিগার্ড বদলে দিলেন আলী। সেখানে নিয়োগ করলেন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী নতুন সৈন্য। ওদের প্রত্যেকেই ছিল একেকজন আদর্শ সৈনিক। নাজি এ পরিবর্তন মেনে নিতে না পারলেও আইয়ুবীর সামনে তা প্রকাশ করল না। সম্বর্ধনায় হাজির হওয়ার জন্য সে আবার আইয়ুবীকে অনুরোধ করল। আইয়ুবী বললেন, ‘কবে আপনার দাওয়াতে যেতে পারব দু’ একদিনের মধ্যেই আপনাকে তা জানাবো।
নাজি চলে গেলে তিনি এ ব্যপারে আলীর পরামর্শ চাইলেন। আলী বললেন, ‘যে কোন সময় আপনি নাজির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন।
পরদিন সালাহউদ্দীন নাজিকে জানালেন, তিনি এখন তার দাওয়াত কবুল করতে প্রস্তুত। নাজি তিন দিন সময় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আইয়ুবী সানন্দে তাতে সম্মতি দিলেন।
অনুমতি পেয়ে নাজি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করল। অনুষ্ঠানটি হবে শহর থেকে দূরে। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে নাচগানের। ঘোড়সওয়াররা তাদের নৈপুণ্য দেখাবে। মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে কুস্তি, নেজাবাজি এৰং তলোয়ারের খেলা। রাতে ওখানেই সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে আলীশান তাঁবু। পুরো অনুষ্ঠানমালা জানানো হল সালাহউদ্দীনকে। তিনি মনযোগ দিয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী শুনলেন কিন্তু নাচগান সম্পর্কে কিছুই বললেন না। এতে নাজি উৎফুল্ল হল। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সেনাবাহিনীর বেশীর ভাগ ফৌজ দুর্বল মুসলিম। ওরা কখনো সখনো মদপান করে, তবে অভ্যস্ত নয়। আপনাকে সম্বর্ধনা জানানোর এ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে ওরা সামান্য পদ পানের অনুমতি চাইছে।’
‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। আপনি আমাকে দাওয়াত করেছেন, আমি সে দাওয়াত কবুল করেছি। ওখানে আপনি কি করবেন তা আপনিই ভাল বুঝবেন। আপনি ওদের কমাণ্ডার। ইচ্ছে হয় অনুমতি দেবেন, না হয় দেবেন না, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোন নির্দেশ দেব না।’
‘মিসরেবর আমীরের জয় হোক।’ আনন্দে গদগদ হয়ে মোসাহেবী কণ্ঠে বলল নাজি। ‘যে কাজ আপনি অপছন্দ করেন আমি তার অনুমতি দেয়ার কে? নেহায়েত আপনাকে উপলক্ষ করে ওরা একটু আনন্দ করতে চাইছে, নইলে এ প্রস্তাব আমি কিছুতেই উঠাবার দুঃসাহস করতাম না।’
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শুনল সালাহউদ্দীনের কর্মচারীরাও। আইয়ুবী নাচগান এবং মদের অনুষ্ঠানে যাবেন শুনে ওরা হতভম্ব হয়ে গেল। চাইতে লাগল একে অপরের দিকে। কেউ বলল, ‘নাজি মিথ্যে বলে সকলকে চমৎকৃত করতে চাইছে।’ কারো ধারণা, ‘নাজি সালাহউদ্দীনকেও হাত করে নিয়েছে।’
এ সংবাদে সবচে বেশী খুশী হল নাজির লোকেরা। দায়িত্বগ্রহণ করার পরপরই সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ভোগবিলাস এবং নাচগান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেনাবাহিনীর জন্য কঠোর নিয়ম পালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ নিয়ম ভাঙার দুঃসাহস কারো ছিল না।
সালাহউদ্দীন আজ নাচগান এবং মদের অনুমতি দিয়েছেন, কাল নিজিেই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, এই ভেবে নাজি মহা খুশী।
কেবলমাত্র আলী বিন সুফিয়ান জাতেন এর গূঢ় রহস্য। এছাড়া আর কেউ জানতো না, কেন নাজিকে অনুষ্ঠানে নাচগান আর মদ পরিবেশনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
রাত নেমেছে। থোকা থোকা জোসনা ঝরে পড়ছে মরুর বালুকারাশির ওপর। হাজার হাজার মশালের আলোয় দিনের মত উজ্জ্বল মনে হচ্ছে সমগ্র এলাকা।
প্রশস্ত ময়দানের একপাশে ফৌজ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বিপরীত দিকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বসার স্থান। যেন কোন সম্রাটের মসনদ। মসনদের ডানে বায়ে চেয়ার সাজানো। একটু দূরে অতিথিদের তাঁবু। আরেকটু সরে গিয়ে বিশাল এক তাবু তৈরী হয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অবকাশ যাপনের জন্য।
সূর্য ডোবার পূর্বেই আলী বিন সুফিয়ান ওখানে পৌঁছে তাঁবুর চারপাশে কড়া পাহারা বসালেন। অন্যদিকে নাজি শেষ বারের মত জুকিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিল। নজরকাড়া রূপ লাবণ্যে জুকিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গের অপ্সরা। তার দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল হালকা সুবাস। সে সুবাসে পরিবেশ হয়ে উঠছিল অপূর্ব মোহনীয় ও মাদকতাময়। তার নিরাভরণ কাঁধে সোনালী চুলের বাহার। শরীরে পোষাকের স্বচ্ছ প্রলেপ। সে প্রলেপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল এক অনুপম শিল্প সুষমা। সে সুষমায় ছিল মাখন কোমল এক মোমের পুতুলের জীবন্ত সজীবতা। ঠোঁটে তার অনির্বচনীয় মুচকি হাসি।
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনী
- “আপনি যদি একটি জাতিকে কোনরকম যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করে দিতে চান, তাহলে তাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে অশ্লীলতা আর ব্যাভিচারের প্রচলনের ব্যবস্থা করে দিন।” “নেতারা যে জনগনের নেতৃত্বে থাকে, সেই মানুষদের চেয়ে যখন নিজেদেরকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়, তারা সেই পদের জন্য তখন আর যোগ্য থাকে না।” — সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী
সপ্তম শতকের শুরুতেই মিসর, বাইজেন্টাইন, ইরাক, ইরান, আফগান সহ জেরুজালেম ইসলামের পরিপূর্ন সাম্রাজ্য বিস্তার এবং শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ষষ্ঠ শতকে মহান বীর খালিদ বীন ওয়ালিদের হাতে। মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশায় বহু রাজ্য প্রধানের কাছে ইসলামের আহবান জানিয়ে পত্র পাঠান। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর ও আলকজানিন্দ্রায় রোমক শাসনকর্তা বাদশাহ জুরায়হ মকুকাশ ইবনে ইয়ামিনকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। হযরত হাহিব ইবনে আবি বালতা (রা) মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের দূত হিসেবে উক্ত পত্র নিয়ে মকুকাশের দরবারে পৌঁছেন। মকুকাশ দূতকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন। কিবতীদের মধ্যে সুখ্যাতির অধিকারী মরিয়ায়ে কিবতীয়া ও শিরীন নামে দুজন দাসী, মূল্যবান কাপড় এবং দুলদুল নামের একটি ঘোড়া উপঢৌকন হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি সুকৌশল এড়িয়ে যান। এভাবে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে সামিল হয় অনেকে করে বিরোধিতা। কিন্তু একসময় চিঠি পাঠানো সকল রাজ্যই মুসলমানদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর শাসনামলে হযরত আমর ইবনুল আস (রা) মিসরের রোমক শাসনকর্তাকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে গোটা মিসরকে ইসলামী শাসনাধীনে আনয়ন করেন। মিসর মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এ সময়ে আধুনিক কায়রোর নিকটবর্তী আল ফুততা নামক স্থানে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। উমাইয়া ও আব্বাসীয় বংশের শাসনের পর ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ফাতেমী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশের প্রথম শাসক জহর আল ফুসতাতের পরিবর্তে আল কাহিরা বা কায়রোতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রাজধানীকে সুশোভিত করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলমাদের ক্রমবর্ধমান বিজয় এবং শাসন ছিলো অব্যহত। এই সময়ের মধ্যে ইসলাম এবং ইসলামিক চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজ্য প্রসার, সেনাবাহিনী গঠনে মুসলমান অসামান্য ভূমিকা রাখে। এরপর শুরুহয় ইসলামের উপর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। যার মাত্রা ছিলো অত্যন্ত ভয়াবহ। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইউরোপিয়ান শাসকেরা একেএকে মুসলামদের কাছে রাজ্য হারিয়ে, মুসলমানদের অধীনে থেকে শাসন মেনে নিয়ে, তাদের পবিত্র ভুমিতে ইসলামের ব্যাপক চর্চায় যেমন ছিলো বিচলিত তেমনি আক্রোশে ছিলো জর্জরিত। এহেন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তারা গ্রহন করলো এক মহা কুটকৌশল। যার প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছেদ আর ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিমুখ করে মুসলিম সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ করা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা গঠন করলো গুপ্তচর বাহিনী, শুরু করলো মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা, নকল ইসলামী রীতি, মদ, জুয়া, নারীর ব্যবহার। অশ্লীলতা আর ব্যভিচার মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিতে ইসলাম বিদ্বেষীরা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্ব করে আগাতে থাকলো অত্যন্ত গোপনে আর প্রকাশ্যে আরম্ভ করলো ক্রুসেড। ক্রুসেডের প্রথম যুদ্ধেই জেরুজালেম মুসলমাদের হাত ছাড়া হয়। এর প্রায় ২০০ বছর পর জেরুজালেম আবার পুনরুদ্ধার করেন মুসলিম সেনাপতি, অকুতোভয় সেনা নায়ক, সুলতান গাজী সালাউদ্দীন আল আইয়ুবী। ঝড়গতি সম্পন্ন, আপোষহীন অকুতোভয় আইয়ুবী যখন ইসলামের তরবারি হাতে আবির্ভূত হন তখন ক্রুসেডের সাজানো কৌশল বারেবারে কেপে উঠে। চক্রান্তের জাল ছিড়ে জেরুজালেম ছিনিয়ে এনে শত বছরপর আবার মুসলমানদের হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসেন গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী। বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে ১১৩৭ সালে জন্ম গ্রহন করেন সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল লকব যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”। তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১০৯৯ সালে মুসলমানদেরকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম তাদের দখলে আনেন ইউরোপিয়ানরা। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল। বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। এটা ইউরোপিয়ানদের নিজ বিবরণ অনুযায়ী। শহরে কী নারী, কী পুরুষ, কী শিশু, কী বৃদ্ধ –যাকেই পাওয়া গেছে, তাকেই নিধন করা হয়েছে। বহমান রক্তে নাকী সেদিন ঘোড়ার খোর পিছলে যাচ্ছিল। এই ছিল নিধনের নৃশংসতা।বিজয় ধরে রাখা, পরবর্তী যুদ্ধাদি চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গডফ্রি জেরুজালেমের বাদশাহর পদে সমাসীন হন। অথচ হযরত ওমরের (রা.) খেলাফত কালে জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। বিজয় যখন মুসলমানদের আয়ত্তে তখন জেরুজালেমের অধিপতি পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাস । ওমর (রা.) পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের জানমাল ও ধর্মীয় নিরাপত্তার বিষয়াদি নিশ্চিত করেন। সেই হতে জেরুজালেমে সকল ধর্মের (ইয়াহুদী/খৃষ্টীয়ান) লোকজনের যাওয়া আসা, ইবাদত-আরাধনার নিরাপত্তা বিধিত হয় এবং এটা এভাবেই যুগপৎ হয়ে পড়ে। ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খ্রিষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্তের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর সর্বত্র। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকে যা হার মানায়। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ১১৯০ সালে তৃতীয় ক্রুসেড জয়ের পূর্ব পর্জন্ত ইহুদী, খ্রিস্টান, উপনেবেশিকরা সব ক্রসেডে মুসলমানদের ব্যাপকভাবে নিপীড়ন, নিষ্পেষণ চালায়। ১৩ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকা এই দখলদারিত্বে ইউরোপিয়ান শাসকেরা নানান রকমের অত্যাচার ও নির্যাতন করেন এবং সর্বোপরি যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে যে চরম মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা করেন তার জের এখনও শেষ হয় নি। ইউরোপ ও মুসলমানদের মধ্যে হাজার বৎসরের টানাপোড়নের সম্পর্ক এই যুদ্ধংদেহী তৎপরতার সৃষ্টি। ১১৬৩ সালে তার জেনগি বংশীয় ঊর্ধ্বতন নূরউদ্দিন জেনগি তাকে ফাতেমীয় মিশরে প্রেরণ করেন। ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে সালাহউদ্দীন ফাতেমীয় সরকারের উচ্চপদে পৌছান। ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১১৬৯ সালে তার চাচা শেরেকোহ মৃত্যুবরণ করলে আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তার উজির নিয়োগ দেন। ১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন। ১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা ও হিমস জয় করেন। জেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিল। এরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হন। ১১৮২ সালে আলেপ্পো জয়ের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন সিরিয়া জয় সমাপ্ত করেন। তবে জেনগিদের মসুলের শক্তঘাটি দখলে সমর্থ হননি। সালাউদ্দীনের সাথে ক্রুসেডারদের যুদ্ধ হয় ১১৮৭ সালে। এর কয়েক দশক আগে অপর এক ক্রুসেড যুদ্ধে এই মর্মে বিরতি আসে যে খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যাতায়াতে বাধা দেবে না, ব্যবসায় কাফেলাদেরকে এবং ধর্মীয় কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবেনা। এটাই প্রায় চার যুগ ধরে চলছিল। কিন্তু ১১৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি হজ্জযাত্রী কাফেলাকে রেনোল্ড আক্রমণ করেন, মালামাল লুট করেন এবং তাদেরকে মারধর করে জেলে নিক্ষেপ করেন। রেনোল্ডের উদ্দেশ্য ছিল সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামানো। অবস্থা এই ছিল যে জেরুজালেমের বাদশাহ বল্ডউইন কোষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে তার ভায়রা গী অব লুসিগনান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু গীর সে ধরনের তেমন কোন দক্ষতা ছিল না। তাই তার এক প্রাক্তন-মৈত্রী রেনোল্ড তার কাজে সহায়তা করতেন এবং ‘সুযোগও গ্রহণ করতেন’। রেনোল্ড একজন রক্ত-লিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন। তবে রেনোল্ড কর্তৃক ব্যবসায় কাফেলাকে ইতিপূর্বে হয়রানী করার অভিযোগও আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাই রেনোল্ড ইচ্ছে করেই সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামিয়ে চূর্ণ করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশেই একটি নিরপরাধ, নিরস্ত্র, হজ্জগামী কাফেলাকে আক্রমণ। এরই জওয়াব দিতে আসেন সালাউদ্দীন আইয়ূবী। ১১৮৭ সালে তিনি ক্রুসেডদেরকে দারুণভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর জেরুজালেমে প্রবেশ ও বিজয় ছিল রক্তহীন।
সালাউদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ ও বিকম্পন সৃষ্টি করে। পোপ ৩য় আর্বান হার্ট এটাক করে মারা যান। ক্রুসেডাররা তখনো ধারনা করতে পারেনি সালাউদ্দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আগমন করেছেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে খ্রিস্টানদের মহা বিপর্যয়ের পর মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পোপ ২য় আরবানুসের আহবানে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হল সমগ্র খ্রিস্টান শক্তি। ইংল্যান্ডের রিচার্ড দি লায়নহার্ট, ফ্রান্সের ফিলিপ অগাস্টাস আর জার্মানির ফ্রেডরিকের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান আক্রায় মুসলমানদের অবরোধ করা হয়। ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর মেয়াদী ৬ লাখ সৈন্যের এই বিশাল অবরোধ সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মাত্র ২০ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে প্রতিরোধ করেন। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর অবরোধ তুলে নিয়ে নিজদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে শতশত বছর কোন খ্রিস্টান সম্রাট শত চেষ্টা করেও বাইতুল মুকাদ্দাস আর দখল করতে পারেনি। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা চালায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদস। এভাবেই কুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এর পর দীর্ঘ প্রতিক্ষা, গোলামীর জিঞ্জির ভেংগে, জিল্লতির জীবন ছেড়ে মাথা তোলে দাঁড়াবার জন্য মুসলিম মিল্লাত অপেক্ষা করছিল একজন মুক্তিদূতের। ১০৯৯ সালের পরের কোন এক সময়, তখন আল কুদস ক্রুসেডারদের দখলে। বাগদাদ শহরে এক কাঠমিস্ত্রি থাকতেন।লোকটি মনের সকল ভালোবাসা দিয়ে খুব সুন্দর একটি মিম্বর বানালেন। মিম্বরটির সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক মিম্বরটি দেখতে আসতে শুরু করলো। অনেকেই মিম্বরটি কিনতে চাইতো, কিন্তু কাঠমিস্ত্রির জবাব ছিল এটি বিক্রির জন্য নয় এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য। তার কথাশুনে সবাই হাসতো। কাঠমিস্ত্রিকে পাগল ঠাওরাত। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। একদিন এক ছোট ছেলে তার পিতার হাত ধরে এসেছিল মিম্বরটি দেখতে এবং কাঠমিস্ত্রির কাছ থেকে তার স্বপ্নের কথাও জেনেছিল।ছোট ছেলেটি মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন সে পূরণ করবে। সময়ের ব্যবধানে সেই ছেলেটি মিম্বরটি আল আকসায় স্থাপন করেছিল। তিনি আর কেউ নয়, দিক বিজয়ী বীর সুলতান গাজী সালাউদ্দিন আইয়ূবী। ১৩ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্রুসেডের যুদ্ধ শেষ হলেও ইউরোপিয়ান পক্ষ তাদের মানসিকতা ও আচরণ থেকে ‘ক্রুসেড’ যেন সরাতে পারছেন না। এই বিংশ শতাব্দী ও একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম ভূখণ্ডে যেসব আক্রমণ চালানো হয়েছে; বেপরোয়া ভাবমূর্তিতে অসমতুল্য শক্তির প্রবল প্রয়োগে যে ধ্বংস লীলা চালানো হয়েছে এবং এগুলোতে যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে –এসব বাস্তবতার কীরূপ ব্যাখ্যা মুসলমানেরা গ্রহণ করবে সেটাই হয়ে পড়ে এক মুস্কিলের বিষয়। ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কায় পরমাণু বোমা হামলা চালানোর মতো বিষয়ে পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ কলেজে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালানোর কোর্সে এ বিষয়ে পড়ানো হয়। এসব বিষয় অত্যন্ত নাজুক। এসব বিষয় সামনে রাখলে ‘সভ্যতার’ আওয়াজ যে কত অন্তঃসারশূন্য তা সহজেই বুঝা যায়। সুলতান আইয়ুবী কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণে নেবার প্রায় ৮০০ বছর পর এবং ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের ৪৩ বছর পর মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক অনৈক্য ও দুর্বলতার ফলে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস আর মসজিদুল আকসা আবার চলে গেল বিধর্মীদের হতে। খ্রিস্টানদের মদদে সেখানে কর্তৃত্ব নিল অভিশপ্ত ইহুদী জাতি। ৮০০ বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল সেই পবিত্র মাটিতে। মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করল ফিলিস্তিনের মাটি। যা এখনো বিরাজমান।আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা ক্রন্দন করছে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য। ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সালাহউদ্দিন দামেস্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে এক টুকরো স্বর্ণ ও চল্লিশ টুকরো রূপা ছিল। তিনি তার অধিকাংশ গরিব প্রজাদের দান করে যান।দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরে তাকে দাফন করা হয়। যদিও সালাহঊদ্দীন বহুকাল পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন ,কিন্তু মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি আজও জীবিত ক্রুসেডের হৃদয়ে তিনি আতংক ,আর মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি খোদার আবর্তিত রহমত।
নিচে এই বই টির ডাউনলোড করার দুইটি লিঙ্ক আছে এবং প্রিভিউ লিঙ্ক ও আছে
কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন নিচে আমার ফেসবুক আইডি এর লিঙ্ক দেওয়া আছে.. যদি কোনো ভুল হয় ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন
আসাদ বিন হাফিজ
আসাদ বিন হাফিজ (ইংরেজি: Asad Bin Hafiz) (জন্ম: জানুয়ারী ১, ১৯৫৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং ছড়াকার হিসেবে পরিচিত। তিনি আদর্শিক দিক দিয়ে ফররুখ আহমদের অনুসারী। তাঁর সাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণ এবং বিপ্লবের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৃজনশীলতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সাহিত্যে বিপ্লবী চিন্তা-চেতনারও প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি। তিনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত আছেন। আসাদ বিন হাফিজ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বড়গাও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ হাফিজউদ্দীন মুন্সী এবং মাতা জুলেখা বেগম। কবি আসাদ বিন হাফিজ ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক(সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি বর্তমানে ‘প্রীতি প্রকাশন’ নামের প্রকাশনা সংস্থাটি পরিচালনা করছেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখাতেই কবি আসাদ বিন হাফিজ রেখেছেন তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। তিনি প্রায় ৮১টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
0 Comments